যেদিন ভেসে গেছে

বৃষ্টি ও বিরহ (আগষ্ট ২০২১)

ঐশিকা বসু
  • 0
  • ৪১

সন্ধেবেলায় তুমুল বৃষ্টি। বাসটা যেখানে থামল সেখানে ছাউনি একটা আছে বটে, কিন্তু সেটা বহু পুরনো। শেডটা সম্পূর্ণরূপে আস্ত নেই। এখানে ফুটো, ওখানে ফাঁকা। আর দুপাশে তো একেবারে ভেঙেই পড়েছে। এর তলায় আশ্রয় নিলে যে কেউ ভিজে যাবে। আমার কাছে ছাতা ছিল। তাই ঠিক করলাম, এরকম অস্থায়ী আশ্রয়ে দাঁড়াবার চেয়ে হাঁটা লাগানোই ভালো। মেন রোড দিয়ে মিনিট দুয়েকের হাঁটা, তারপর ডানদিকে যে রাস্তাটা চলে গেছে সেদিকেই আমার গন্তব্য।
সরু পাকা রাস্তা আর দুধারে বড় বড় বৃক্ষ শ্রেণীর গাছ লাগানো। এই অঞ্চলে আমি নতুন এসেছি। কিন্তু এই রাস্তাটা আমার খুব ভালো লাগে। দিনের চড়া রোদে হোক কিংবা পড়ন্ত বিকেল এই ছায়াঘেরা রাস্তাটা দিয়ে হাঁটবার মজাই আলাদা। মেনরোড থেকে রাস্তায় সবে ঢুকেছি, মনে হল আমার পিছন পিছন কেউ দ্রুত আসছে। আমি কিছু বুঝে ওঠবার আগেই হুট করে সে আমার ছাতার তলায় চলে এলো। তারপর হাসিমুখে বলে উঠলো, ‘ওফ্ খুব বৃষ্টি। আমি বেশিদূর যাবো না। সামনেই আমাকে ছেড়ে দেবেন?’ এই বলে সে আমার মুখের দিকে তাকাল। আমিও তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম। আমার বুকের কাছটা ধক্ করে উঠলো। এতোটাই অবাক হয়ে গেলাম যে মুখ ফসকে বেরিয়েই গেল, ‘সুলগ্না তুমি?’
রাস্তাটায় স্ট্রীটলাইটগুলো সেদিন সবক’টা জ্বলছিল না। আধো আলো আধো অন্ধকার। জায়গাটাও একেবারে নির্জন। এমনিতেই আমাদের এখানে লোকবসতি খুবই নগণ্য। তার ওপরে এখন এই বৃষ্টিতে কেউই বেরোয়নি। এমন একটা জায়গায় সুলগ্নার সাথে দেখা হয়ে গেল!! আমার হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি বৃষ্টির শব্দ ভেদ করে যেন আমার কানে আসতে লাগলো। ওর অবস্থা আমার থেকেও খারাপ। সে যে শুধু অবাক হয়েছে তাই নয়। আমার সাথে এভাবে একসাথে এসে পড়ায় সে চূড়ান্ত লজ্জিত এবং বোধহয় মনে মনে অনুশোচনাও করছে। বোধ করি, অন্য কাউকে ভেবে ও আমার ছাতার তলায় চলে এসেছে। সুলগ্না হয়তো চলেই যেতো, কিন্তু আমিই নিজের প্রাথমিক বিহ্বলতাটাকে কিছুটা কাটিয়ে জোর করে বলে উঠলাম, ‘কোথা থেকে আসছো?’ সে কোনো উত্তর করলো না। বুঝতেই পারলাম, আমার পাশে এভাবে হাঁটতে সে খুব অস্বস্তি বোধ করছে। আমাদের দুজনের দেখা না হওয়াটাই উচিত ছিল। কিন্তু দেখা যখন হয়েই গেছে, তখন বৃষ্টির মধ্যে ওকে ছেড়ে দেওয়াটা মোটেই শোভনীয় হবে না। এই মনে করে আমি ওর সাথে আরেকটু আলাপ জমাতে চেষ্টা করলাম।
আবারও জিগ্যেস করলাম, ‘কোথায় গেছিলে তুমি?’
‘দোকানে।’ মৃদু গলায় খুব সংক্ষিপ্ত উত্তর এলো। আমিও একটু উৎসাহিত হয়ে বললাম, ‘কি দুর্যোগের দিন বল দেখি।’ আমার এইভাবে আলাপ জমানোর চেষ্টায় ও খুব একটা খুশী হল কিনা জানি না। তবে আমাকে হঠাৎ ও বলে উঠলো, ‘আপনার দিকে ছাতাটা নিন। আমার লাগবে না। আপনি ভিজে যাচ্ছেন।’ আমি বললাম, ‘ঠিক আছে। তোমার বাড়ি কোথায়?’ ও উত্তর দিলো, ‘আমি চলে যাবো। আপনি ছাতা নিয়ে আপনার মতো চলে যান।’ কিন্তু ওর সংকোচটা না ভাঙিয়ে ওকে ছাড়বার ইচ্ছে আমার ছিল না।
মিনিটখানেক হাঁটতেই ওর বাড়ি এসে পড়লো। একতলা ছোট বাড়ি। আর বাড়ির সামনে কিছুটা জায়গা। উঠোনটা আগাছায় ভর্তি। মনে হয় অনেকদিন এর পরিচর্যা করা হয় না। ওর বাড়ির সামনে এসে ওকে ছাড়তে যাবো, এমন সময় প্রচণ্ড একটা আলো এসে আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিলো। আর সাথে সাথে কান ফাটানো শব্দে বাজ পড়লো সামনের নারকেল গাছটার মাথায়। জীবনে এতো কাছ থেকে আমি কখনো বাজ পড়তে দেখিনি। সুলগ্না ভয়ে চিৎকার করে উঠলো। আমি ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলাম। খানিকবাদে সে কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বলল, ‘কি সাঙ্ঘাতিক।’ এই বলে এক দৌড়ে সে তার বাড়ির বারান্দায় ঢুকে গেলো। আমিও চলে যাচ্ছি। এমন সময় ও আমাকে আলতো স্বরে ডাকল, ‘আপনার কি খুব তাড়া? মানে বলছিলাম যে, বাজ পড়বার সময় এভাবে গাছের তলা দিয়ে না যাওয়াই ভালো। আপনি চাইলে এখানে বসতে পারেন।’
আমি হাসিমুখে ওকে আশ্বস্ত করে বললাম, ‘সেকথা ঠিক। বাজের সময় না বেরোনোই ভালো।’ এই বলে আমি ওর ঘরের বারান্দায় ঢুকে পড়লাম। বারান্দাটা কিঞ্চিৎ অন্ধকার। এর একপাশে একটা মোড়া রয়েছে। ও আমার দিকে একবার তাকাল। ‘আপনি ঐ মোড়াটা টেনে নিয়ে বসুন না।’ কথাটা বলে ধীর পায়ে ও ঘরে চলে গেলো।
মোড়াটা টেনে বসতে বসতে কেবলই মনে হচ্ছিলো, এ আমি কার বাড়ি এসে পড়লাম? কেনই বা এলাম এখানে? মনে হচ্ছিলো, তখনই বৃষ্টির মধ্যে উঠে চলে যাই, কিন্তু যেতে গিয়েও কেমন একটা আড়ষ্টভাব এলো দুটো পা জুড়ে। একটানা বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে চলে যাচ্ছিলাম স্মৃতি পাতা উল্টে আজ থেকে বেশ কয়েকবছর আগে।


তখন সবে চাকরি পেয়েছি। বাবা-মা দুজনেই বিয়ের জন্য পীড়াপীড়ি করতে শুরু করে দিল। প্রথমে তো আমার ইচ্ছেই ছিল না। বিয়ের কথা উঠলেই ‘এখন করবো না’ ‘দূর ছাই যাও তো এখান থেকে’ ‘তোমাদের শুধু এক কথা’ ইত্যাদি বলে একবছর কাটিয়ে দিলাম। কিন্তু তারপর তো আর কাটে না। আর আমাদের পরিবারের রীতিই হল ছেলেদের বিয়ের বয়স ২৫-২৬এর বেশি এগোবে না। কিন্তু আমি নিমরাজি। সবে তখন আমি চাকরি পেয়েছি। হাতে দুটো পয়সা এসেছে। এসময়ে ঘুরে বেড়ানো, নাটক দেখা, সিনেমা দেখা, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারা এসব করবো না বিয়ে করে সংসারের ঠেলা সামলাবো? কিন্তু বাবা-মাও ছাড়ে না। তারাও তাদের ঘ্যানঘ্যানানি চালিয়ে যায়। তারপর সেই ঘ্যানঘ্যানানি বাবা-মা থেকে ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়লো কাকা, পিসে, মেসো, মামা সর্বত্র। তখন আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে দেখা হলেই সেই একই বচন – ‘এবার চাকরি পেয়েছ, হাতে দুটো পয়সা এসেছে। এবার আর তবে দেরী কেন?’ শুধু আমাকেই বোঝানো নয়, বাবা-মায়ের সাথেও দিনরাত চলতো তাদের গুজুর-গুজুর ফুসুর-ফুসুর। তার ফলটা হত এই যে বাবা-মা দুজনেই আগের থেকে আরো দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তো, সংসারের ফাঁস আমার গলায় পড়ানোর জন্য।
অগত্যা দেড়-দুবছর বাদে মত দিতে বাধ্য হলাম। বাড়িতে, আত্মীয়বাড়িতে খুশীর জয়ডঙ্কা বেজে উঠলো। পরিবারের লোকেদের একেবারে যেন উদ্ধার করে দিয়েছি।
সুলগ্নার পরিবারের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগটা হয়েছিলো বাবার এক বন্ধুর সূত্রে। দিনক্ষণ ঠিক করে, একদিন ধূসর দুপুরে প্রথম দেখা হয়েছিলো আমাদের। সুলগ্নার মা নেই। বাবাও বেশ অসুস্থ, অবসরপ্রাপ্ত। পেনশনের টাকায় ওদের সংসার চলে। প্রথমদিন ওকে দেখে আমার যে বিশেষ পছন্দ হয়েছিলো তা নয়। গায়ের রং যথেষ্ট চাপা, বেঁটেখাটো চেহারা। আকর্ষণ করবার মতো বিশেষ ক্ষমতাও ওর ছিল না, আর ইচ্ছেটাও যেন ছিল না। সাধারণ একটা নীল রঙের চুড়িদার পরে আমাদের সামনে এসে বসলো। চুলটা একটা খোঁপা করে বাঁধা। প্রাথমিকভাবে কিছুক্ষণ কথা বলা হল। আমার বাবা ওকে বেশ কিছু প্রশ্ন জিগ্যেস করলো। তাতে জানলাম, সুলগ্না বি.এ পাশ করেছে বাংলা নিয়ে। গল্পের বই পড়ার শখ। ওর বাবা বলল, ‘মেয়ে সারাদিন বিভিন্ন বই নিয়েই বসে থাকে। বই পেলে আর কিছু চায় না। টিউশানির টাকায় বই কেনে আর পড়ে।’ তারপর কিছুক্ষণ থেমে সে বলে, ‘আমার যা হার্টের রোগ, তাতে কখন যে কি হয়ে যায়…।’ মেয়ে বাবার কথার প্রতিবাদ করে বলে, ‘তুমি থামবে বাবা?’ খানিকক্ষণ কথাবার্তার পর একান্তে আলাপ করার জন্য আমাদের অন্য একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হল।
সুলগ্নাকে ভালো লাগাটা আমার এখান থেকেই শুরু। বাড়িতে গিয়ে এই বিয়েতে আমার সম্মতি জানানোর সময় ওর কিছু কিছু কথা আমার মনে পড়ছিল। হয়তো তাই এতো সহজে আমি সম্মতি জানিয়েছিলাম। সুলগ্নাও বিয়েতে রাজী হয়েছিলো। পাঠক হয়তো এখানে জানতে চাইবেন, সুলগ্না আমাকে কী এমন বলেছিল যে ওর প্রতি আমার হঠাৎ এতো অনুরাগ জন্মে গেলো। কিন্তু সেকথা আমি কাউকে বলবো না। সে যে আমার অন্তরের সম্পদ, আমার একান্ত নিজস্ব।
বিয়েতে আমার মত আছে শুনে সকলেই খুব খুশী। যত শীঘ্র সম্ভব দিন ঠিক করা হয়ে গেলো। বিয়ের দিন নয়। মেয়ের বাড়ি থেকে এ বাড়িতে আসার দিন। জানা গেলো, ঐ দিন পরিবারের অন্যান্য লোকেদের সাথে সুলগ্না নিজেও আমাদের বাড়িতে আসছে। আমার বাবা – মা যদিও ব্যাপারটা ভালো চোখে দেখল না। তাদের বক্তব্য ছিল, মেয়ের এখনই আসার কি হয়েছে? বিয়ের তো এখনও কিছু ঠিকই হল না। কিন্তু আমার এতে খুব ভালো লাগলো। আমি যদি তাকে দেখতে যেতে পারি, তবে ও কেন আমাকে দেখতে আসতে পারে না?
ওদের বাড়ি থেকে দেখতে আসার কয়েকদিনের মধ্যেই আমাদের মধ্যে কথাবার্তা শুরু হয়। প্রথম প্রথম ফোনে আলাপ, তারপর সেখান থেকে সম্পর্কটা গাঢ় হতে লাগলো। অফিসের যত কাজ, যত খুঁটিনাটি, সব গল্প করে বলতাম সুলগ্নাকে। ও মন দিয়ে শুনত, কখনো কখনো মন্তব্য করতো, প্রশ্ন করতো। ওকে বলতাম, ‘তোমাকে কথাগুলো না বললে না, আমার ঠিক ফ্রেশ লাগে না।’ ও বলতো, ‘তোমার কাছ থেকে এগুলো না শুনলেও আমার ভালো লাগে না। যেন কত বুঝছি।’ এই বলে ও হেসে উঠত।
এক ছুটির সকালে জন্মভূমি পত্রিকার পাতা ওলটাতে গিয়ে দেখি, সুলগ্নার নাম। ওর লেখা কবিতা এই পত্রিকায় বেরিয়েছে? যতদূর জানি, জন্মভূমি পত্রিকাটা প্রতিষ্ঠিত লেখকদের লেখা ছাড়া সাধারণত ছাপে না। আমি কবিতাটা পড়তে লাগলাম। একজন মাঝি, নদীর বুকে নৌকা চালাচ্ছে। তাকে জীবননদীতে ভাসমান মানুষের যাপন হিসেবে দেখানো হয়েছে। পড়তে পড়তে যখন শেষ লাইনটা চলে এল, অনুভব করলাম, আমার দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।
তখনই ওকে ফোন করলাম। বললাম, ‘কি ব্যাপার কি? জন্মভূমি পত্রিকায় লেখা বেরিয়েছে, আর আমাকে জানাওনি? ও বলল, ‘বেরিয়েছে বুঝি? আসলে আমি তো নিজেই জানতাম না। আমার ফোনটা দোকানে, তাই হয়ত ওরাও জানাতে পারেনি। আর ইমেল-টিমেল আমি খুলিই না।’ ওর কথার উত্তর না দিয়ে আমি বললাম, ‘তুমি এই পত্রিকায় লেখো, সুলগ্না?’ ও বলল, ‘হ্যাঁ, লিখি তো। গতবারের শারদীয়াতেও আমার একটা ছোটগল্প আছে। তুমি পড়ো।’ আমি বললাম, ‘জানো, এই জন্মভূমি পত্রিকাটা আমি কেন রাখি?’ ও বলল, ‘কেন?’ আমি বললাম, ‘ভালো মানের লেখা কিভাবে লিখতে হয়, সেটা শেখার জন্যে।’ ও পাশ থেকে কোনো উত্তর এলো না। শুধু দ্রুত নিঃশ্বাস পড়ার আওয়াজ ভেসে এলো।

আমার বিয়ের ব্যাপারটা প্রাথমিকভাবে ঠিক হয়ে যাওয়ার পর আমাদের বাড়িতে এক সন্ধেবেলায় এল ভণ্ডুলজেঠু। সম্পর্কে বাবার জ্যাঠতুতো দাদা। দুর্গাপুরে থাকে। মামন অর্থাৎ ভণ্ডুলজেঠুর মেয়ের পরীক্ষা চলছিল বলে বিয়ের কথাবার্তার সময় ওরা আসতে পারেনি। ভণ্ডুলজেঠুর নাম কিভাবে ‘ভণ্ডুল’ হল, তা আমার ভালোভাবে মনে নেই। কিন্তু এটুকু মনে আছে আমার পিসতুতো দাদা বাচ্চু ওকে এই নামে ডাকতো। ওর দেখাদেখি আমরা অন্যান্য ভাইবোনেরাও এই নামে ডাকতে শুরু করেছিলাম। তাতে অবশ্য কেউই আপত্তি করেনি। তবে এর পিছনে বিভূতিভূষণ যে বাচ্চুদার ওপরে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিলেন সেটা সহজেই অনুমেয়।
সে যাই হোক, নামটা শুনতে মজাদার হলেও মানুষটা কিন্তু মোটেই মজাদার নন। ছোটবেলায় তো আমরা একে যমের মতো ভয় পেতাম। গাঁট্টাগোট্টা চেহারা। মিশকালো গায়ের রং। ওর বপু দেখলে এমনিতেই ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। তবে আমরা ওকে যেমন ভয় করতাম, তার চেয়েও সে বেশি ভয় করত লোকসমাজ আর লোকধর্মকে। সমাজের হেন নিয়ম নেই যা সে মেনে চলত না। নিজেই যে সেটা শুধু মানতো, তাই নয়, আমাদেরকেও মানিয়ে ছাড়ত। তাই ছোটবেলা থেকেই ওর কাছে ঘেঁষতে বিশেষ একটা ভরসা হতো না। সকালে ঘর না ধুয়ে বাসি ঘর থেকে বেরোনো যাবে না, কোথায় কোন এঁটো ছুঁয়ে ফেললে আবার গঙ্গাজলে হাত ধুতে হবে, কোনটা শুভ কোনটা অশুভ ইত্যাকার নানান ঝামেলার জন্য পারতপক্ষে আমরা ওর সঙ্গ এড়িয়েই চলতাম। এখন যমের ভয়টা গেলেও ওর প্রতি আড়ষ্টভাবটা যথেষ্ট আছে। তবে আমাদের পরিবারের কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজই জেঠুর হস্তক্ষেপ ছাড়া হয় না। বাবা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে জেঠুর মতামতের খুব গুরুত্ব দেয়। তাই আমার বিয়ের কথা শুনে জেঠু বলেই ফেলেছিল, ‘জিতুর বিয়ে হবে, আর তোরা নিজেরাই সব ঠিক করে ফেললি? তোরা বুঝিস কি?’ কথাটার মধ্যে একটু হলেও অভিমানের সুর ছিল। বাবা তাই বলল, ‘আরে সবে তো প্রাথমিক কথাটা হয়েছে। তুমি এসো, তারপর ফাইনাল হবে’খন।’
তাই জেঠু এসেছিলো এবারে সপরিবারে। শুভদিন ঠিক করে আমি বাদে ওরা সবাই বিয়ের শেষ পর্বের কথাবার্তা সারতে গেল সুলগ্নাদের বাড়িতে। বড়োদের সিদ্ধান্তে মাথা গলানোর কোনো অধিকারই আমার ছিল না তখন। আর ভণ্ডুলজেঠুর সামনে তো একেবারেই নয়। তাই নিজের সিদ্ধান্তটুকু জানিয়েই নিজেকে সবটুকু থেকে সরিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছিলাম আমি। এটাই ছিল আমাদের পারিবারিক শিক্ষার নমুনা। সেদিন সন্ধেবেলায় ওরা যখন বাড়ি ফিরল, বাবা আর মায়ের মুখটা কেমন থমথমে মনে হল। আমি সেদিন আঁচ করেছিলাম, কিন্তু বুঝতে পারিনি।
পরেরদিন আমার অফিস। আর অফিসের খুব কাছেই সুলগ্নাদের বাড়ি। তাই ওকে বলেছিলাম অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়বো, তারপর দুজনে ঘুরতে যাবো। আমাদের এই বেড়াতে যাবার ব্যাপারটা অনেক আগেই ঠিক করা হয়ে গেছিলো। সেদিন অফিসে যাবার আগে বাবা আমাকে ডাকল। তারপর কোনোরকম ভূমিকা ছাড়াই বলতে শুরু করলো, ‘সুলগ্নার সঙ্গে মেলামেশাটা এখন আর বেশি একটা করিস না। এখনও তো বিয়ে ঢের দেরী। আরো কয়েকটা মাস যাক, তারপর কথাবার্তা বলিস।’ কথাগুলোর মধ্যে একটা আদেশোচিত ভঙ্গী ছিল যেটা বাবার কাছ থেকে খুব একটা আশা করা যায় না। বাবা তো সাধারণত এমন বলে না, বরং সে তো নিজেই সুলগ্নার সাথে কথা বলার ব্যাপারে আমাকে উৎসাহিত করেছিলো। যে ঘরে দাঁড়িয়েছিলাম, তার পাশেই রান্নাঘর। সেখান থেকে মায়ের গলা ভেসে এলো, ‘আজ তোদের কোথায় বেড়াতে যাবার প্ল্যান আছে না? একদম যেন যাবি না। ওকে বলে দিস তোর শরীর খারাপ হয়েছে। তুই যেতে পারবি না।’ মায়ের কথার তীব্র প্রতিবাদ করে আমি বলে উঠলাম, ‘কিন্তু কেন?’ ওরা তখনই কিছু বলল না। আর আমারও অফিসের দেরী হয়ে যাচ্ছিলো, তাই এই নিয়ে কথা আর বিশেষ এগোল না।
সেদিন অফিসে বসে কোনো কাজেই মন লাগলো না। বারবার বাবার কথাগুলো মনে হচ্ছিলো। বাবা কেন এমনটা বলল? বাবা কি তাহলে চায় না আমার সাথে সুলগ্নার সম্পর্কটা থাকুক? ভণ্ডুলজেঠুর সাথে ওদের বাড়িতে যাওয়ার পর থেকেই বাবা কেমন যেন একটা অস্বস্তিতে ভুগছে। অথচ স্পষ্ট করে কিছু বলছেও না। তাহলে ওদের বাড়িতে কি সেদিন কিছু অশান্তি বেঁধেছিল? কিন্তু তেমনটা হলে সুলগ্না তো আমাকে জানাতো। গতকাল রাত্তিরে ওর সাথে যখন কথা বললাম, তখন তো কিছু শুনলাম না।
যাই হোক, সেদিন দুজনে মিলে একটু গঙ্গার ধারে গেছিলাম। ঘাটটা খুব সুন্দর করে বাঁধানো। একটা পার্কও আছে। কিন্তু আমরা সেদিকে গেলাম না। তারই অনতিদূরে একটা সুবিশাল বট গাছ। তার ছায়ায় নরম ঘাসের ওপর আমরা বসে পড়লাম। সামনে গঙ্গা বয়ে চলেছে। সুলগ্নার খেয়ালগুলো বড়ই অদ্ভুত। একটা বটপাতা নিয়ে সে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিল। আমি বললাম, ‘তুমি তো এখানে ভাসিয়ে দিলে। এবার এটা ভাসতে ভাসতে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশবে।’ আমার বলার সঙ্গে সঙ্গে পাতাটা ভাসতে ভাসতে এক ধারে চলে এসে পাড়ের বড়ো বড়ো ঘাসের মধ্যে আটকে গেলো। সুলগ্না সেটা দেখে ফিচ করে হেসে ফেললো। আমি একটু কবিত্ব করে বলতে শুরু করলাম, ‘কার যে কোথায় গন্তব্য আগে থেকে কিছুই বলা যায় না।’ আমার কথা শুনে সুলগ্না ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে বলে, ‘কি মশাই, খুব কবিত্ব হচ্ছে, না?’ তারপরেই আমাকে একটা কবিতা শোনাবার অনুরোধ করলো। আমি বললাম, ‘আমি তো কবিতা ঠিক মনে রাখতে পারি না। পড়ি, ভালো লাগে, ব্যস এই পর্যন্তই।’ ও আমার কথা শুনে চুপ করে যায়। তারপর একটু উদাসভাবে একটা কবিতা শুরু করে –
“হাতের ওপর হাত রাখা খুব সহজ নয়
সারা জীবন বইতে পারা সহজ নয়
এ কথা খুব সহজ, কিন্তু কে না জানে
সহজ কথা ঠিক ততটা সহজ নয়।”
‘কার লেখা বল তো?’ প্রশ্নটা আমার দিকে ছুঁড়ে দেয় ও। নামটা ঠিকমতো মনে আনতে না পেরে আমি বলি, ‘বাংলা সাহিত্যের অত্যন্ত বিখ্যাত এক কবি।’ ও কিছু উত্তর দেয় না। বলে, ‘আমি একটা গল্প লিখেছি। তোমাকে মেলে পাঠিয়ে দেবো। পড়ে বোলো তো, কেমন লাগলো? ভালো হলে একটা ম্যাগাজিনে পাঠাবো।’ ‘আমার বুদ্ধির ওপর তোমার ভরসা আছে? আমার কিন্তু নেই।’ এই বলে সশব্দে হেসে উঠি আমি।
মৃদু বাতাস বইছে। সুলগ্নার চুলগুলো চোখের সামনে এসে পড়ছে বার বার। সাদা শালোয়ারে ওকে মানিয়েছে বেশ। বাঁ গালে একটা ছোট্ট আঁচিল, চোখে রিমলেস চশমা। ওর দিকে তাকিয়ে আমি ভাবছিলাম, ও ঠিক আমার বৌ নয়। ও আমার প্রেমিকা।
হঠাৎ আমার দিকে ফিরে মৃদু হেসে ও জিগ্যেস করে, ‘কি দেখছ?’ এমনভাবে ওর দিকে তাকিয়ে থাকাটা উচিত হয়নি। মনে মনে লজ্জিত হয়ে আমি কথা ঘোরাবার জন্যে বললাম, ‘অফিসে আজ আমাকে এক সিনিয়র দাদা জিগ্যেস করছিল, কবে বিয়ে করছি। আমি এখনও কিছু জানাইনি। পাকা কথা হোক।’ ও বলতে লাগলো, ‘জিতু, বিয়ের পরেও আমি কিন্তু লেখালিখিটা ছাড়বো না। তুমি আমাকে লেখার সময় দেবে তো?’ আমি বলি, ‘নিশ্চয়ই দেবো।’ সারাদিন কি করলাম, কি খেলাম, কোথায় গেলাম এইসব কথা কত সাধারণ। না করলেই বা কি এমন এসে যেতো? কিচ্ছু না। তবু এইসব কথাতেই কখন যে সন্ধে নেমে গেলো, সে খেয়ালই আমরা কেউ করলাম না। আমি ওকে অফিসের কোনো একটা কাজের ব্যাপারে ভালো করে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম, এবং এটা বলার চেষ্টা করছিলাম যে কাজটা কত কঠিন এবং আমি একার চেষ্টায় কিভাবে সেটা উদ্ধার করেছি। এমন সময় ও একপ্রকার চেঁচিয়ে বলে উঠলো, ‘সাতটা বাজে।’
ফেরবার পথে কথাপ্রসঙ্গে ওকে জিগ্যেস করলাম, ‘আচ্ছা, গতকাল আমাদের বাড়ি থেকে তোমাদের বাড়িতে যাওয়ার পরে কী কথাবার্তা হয়েছিলো?’ ও মাথা নেড়ে বলল, এ ব্যাপারে ও কিছুই জানে না।
অফিসে কঠিন কাজের দোহাই দিয়ে বাড়িতেও বাঁচলাম। এবং আরো এক কাঠি ওপরে উঠে এটাও বললাম যে আমাকে ছাড়া আর কারুর দ্বারাই কাজটা সম্ভব হত না। অনেক জটিল কাজ। না হলে কি আর বাড়ি ফিরতে এতো দেরী হয়। মা-বাবা দেখলাম আমার কথার কোনো প্রতিবাদ করলো না। শুধু রাতের বেলার খাবার সময় এমন একটা কথা বলল যা শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।
টেবিলে খেতে বসেছিলাম তখন আমি, বাবা আর ভণ্ডুলজেঠু। মা আর জেঠিমা পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের খাবার পরিবেশন করছিল। অনেক ভূমিকা টুমিকা করে বাবা বলে উঠলো, ‘দেখ, অনেক কিছুই তো আমাদের হাতে নেই। ইচ্ছার বিরুদ্ধেও অনেক কাজই করতে হয়।’ তারপর আবার একটু থেমে বাবা বলল, ‘দাদা গতকাল ওদের বাড়ি গিয়ে সব দেখেশুনে কোনো আপত্তি করেনি। এই বিয়েতে ওরও মত আছে। তবে একটা ব্যাপার। এটা আমার মাথাতেই ছিল না। দাদাই বলল, একবার দুজনের রাশিটা মিলিয়ে নিতে হবে। আমাদের পরিবারের সকলের বিয়ের সময়েই রাশি মেলানো হয়। ব্যাপারটা আমার মাথাতেই ছিল না।’ বাবা এইটুকু বলেই থেমে গেল। জেঠু মুখে ভাত নিয়েই বাবার কথার জের টেনে বলতে শুরু করলো, ‘আরে বাবা, তার থেকেও বড়ো কথা, জাতিতে ওরা নমঃশূদ্র। আর আমাদের শরীরে বইছে ব্রাহ্মণের রক্ত। কিভাবে এই বিয়েতে তুই সম্মতি দিতে পারিস বিমল? ‘মেয়েটা ভালো’ এইটুকুই কি তোদের যথেষ্ট মনে হল? তোর বংশের প্রতি তোর কি এতোটুকুও সম্মান নেই?’ কথাগুলো বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেও ঘা’টা পেলাম আমি। তারপর আবার শুরু করলো, ‘আর মেয়েটার আছেটাই বা কী? না আছে রূপ, না কিছু।’ জেঠুর কথা শুনে আমার খাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গেলো। অন্য কেউ হলে রাগে ফেটে পড়তাম। কিন্তু ভণ্ডুলজেঠুর কাছে সেই রাগ দেখানোর সাহস আমার ছিল না। আমি মাথা নিচু করে রইলাম। বুঝতে পারছিলাম, মা আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কি একটা বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল মা। আমার বুঝতে অসুবিধা হল না, এ বিয়েতে ওদের মত নেই। রাশি মিললেও নেই, না মিললেও নেই।
তবে রাশি মেলেনি। জ্যোতিষমশাই বললেন, দুজনের বৈবাহিক জীবনে যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিতে পারে। বাবা কলকাতায় অন্য এক বড়ো জ্যোতিষের কাছে গেলো। তারও একই বক্তব্য। আজন্ম সংস্কারের চাপে বাবার পক্ষে এরপর এই বিয়ের ক্ষেত্রে এগোনোর ইচ্ছা বা ক্ষমতা কোনোটাই রইল না। সেইমতো বাবা আমাকে বোঝাল। মাও অনেক বোঝাল। ভণ্ডুলজেঠুও আমাকে অনেক জ্ঞান দিলো। কিন্তু আমি তখন নাছোড়বান্দা।
আমি এই সময় সুলগ্নার সাথে কথা বলতে চাইলাম। আর কার সাথেই বা বলবো আমি কথা? কিন্তু যখন ওর সাথে কথা বললাম, সেটা আমাকে আরো হতাশ করল। ও বলল, ‘দেখো, ওরাই তো আমাদের বিয়েটা ঠিক করেছে। আজ ওরা যখন চাইছে না তখন…’। আমি রাগে ফেটে পড়লাম, ‘মানে? তুমি কী বলতে চাও? ওরা যখন খুশি আমাদের সম্পর্কটা গড়ে তুলতে বলবে। আবার যখন খুশি তাকে ভেঙে দিতে বলবে? এটা কখনো হয়? ভণ্ডুলজেঠু এভাবে তোমাকে আর তোমার পরিবারকে অপমান করলো, আর তুমিও কিভাবে এগুলো সহ্য করে রয়েছ?’ আমি রেগে ওকে অনেকক্ষণ ধরে বকাঝকা করলাম। ও আমার কথার কোন প্রতিবাদই করলো না। আমার বলা শেষ হয়ে গেলে ও মৃদুস্বরে বলে উঠলো, ‘মেয়েদের অনেককিছুই মেনে নিতে হয় গো। তুমি দেখো, তুমি ভালো বৌ পাবে। অনেক সুখী হবে। মা-বাবা যা করে তা ভালোর জন্যেই করে। আমার কথা আর নাই বা ভাবলে। কারুর তাতে এসে যাবে না।’
সেদিন বড্ড অভিমান হয়েছিলো। ওর ওপর অভিমান হয়েছিলো, আমার মা-বাবার ওপর অভিমান হয়েছিলো, গোটা পৃথিবীটার ওপর অভিমান হয়েছিলো। আমার সামনের রঙিন পৃথিবীটা এভাবে হঠাৎ ধূসর হয়ে যাবে? এটা আমি কীভাবে মেনে নেবো? আমার শত প্রতিরোধের পরেও একসময় বুঝতে পারলাম, সুলগ্নাকে ভুলে যেতেই হবে। ওকে পাবার ক্ষমতা আমার নেই। তখন আমার সমস্ত জমানো অভিমান, গোটা দুনিয়াটার প্রতি আমাকে নিঃস্পৃহ করে তুলল। পরিস্থিতিকে মেনে নিতে বলে বাবা আমাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলো। মা তো বলেই দিলো, তার কাছে সুলগ্নার চেয়ে ঢের ভালো পাত্রীর খোঁজ আছে। কিন্তু ওরা দেখল, আমি এখন সবকিছুতেই অত্যন্ত বীতস্পৃহ। গোটা দুনিয়াটার ওপর থেকেই আমার সব আগ্রহ দূর হয়ে গেছে।
ঠিক এই সময়েই আমার প্রোমোশনের খবর এলো আর প্রোমোশনের পর আমার নতুন পোস্টিং হল জলপাইগুড়ি। আমি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কেউ জানে না, কিন্তু জলপাইগুড়িতে আমি ফি-বছর আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে আবেদন করে গেছি যাতে সেখান থেকে বাড়ির কাছে আমার বদলী না হয়। এইসময়ের মধ্যে বাড়িতে আমি আর প্রায় যাইনি বললেই চলে। এর বছর তিনেক বাদে আমার বাবা মারা যায়। মা’কে দেখাশোনা করার কেউ নেই। সে একা হয়ে পড়েছে। তার ওপর তিন বছরের পুরনো ঘটনার ক্ষতটা পুরো না সারলেও এখন অনেকখানি শুকিয়ে এসেছে। তাই আমি এবার বদলির জন্য আবেদন করলাম। বছর দুই বাদে আমার আবার বদলী হল। আমি আবার আমার পুরনো জায়গায় ফিরে এলাম। কিন্তু এ জায়গা আমার বেশিদিন ভালো লাগলো না। এই বাড়ি, এই ঘরগুলো, এই টেবিল চেয়ার – সব কিছুতেই একটা পুরনো অসুখের গন্ধ। ঠিক করলাম, এই বাড়ি ছাড়বো। নতুন ফ্ল্যাটের সন্ধানে রইলাম। গত মাসে এখানকার এই ফ্ল্যাটে উঠেছি। কলকাতার কাছেই।

বৃষ্টিটা ধরে এসেছে। আমার সামনের উঠোনটা জলে থৈ থৈ করছে। আকাশ এখন অনেকখানি পরিষ্কার। হাল্কা মেঘের পাশে উঁকি দিচ্ছে শ্রাবণের চাঁদ। এবার আর এখানে থাকা চলে না। মোড়া থেকে উঠে সুলগ্নাকে ডাকলাম। ও বোধহয় ভেতরের ঘরে ছিল। কোনো সাড়া এলো না। আরো দুবার ডাকার পরও যখন সাড়া পেলাম না, তখন বিনা অনুমতিতেই ঘরে ঢুকে পড়লাম। প্রথমে একটা ছোট বৈঠকখানা। সেটা পার করে একটা অন্ধকার ঘর। তার ওপাশের একটা ঘরে আলো জ্বলছে। ঘরটার কাছে যেতে দেখলাম, ঘরটা ছোট। ঘরের প্রায় অর্ধেক অংশ জুড়ে একটা খাট পাতা। তার সামনে একটা চেয়ার। না, ভুল বললাম, চেয়ার নয়, হুইলচেয়ার। সেই হুইলচেয়ারে বসা একটা লোককে বাটি আর চামচে করে কি একটা পানীয় খাইয়ে দিচ্ছে সুলগ্না। লোকটা যেন আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। স্থির মাছের মত দৃষ্টি তার। আমি বুঝতে পারলাম না, সে আমাকে দেখছে নাকি অন্য কিছু দেখছে। ‘কিছু বলবেন?’ সুলগ্না আমার দিকে তাকিয়ে কিছুটা অপ্রস্তুতভাবে বলে ওঠে। আমি মাথা নাড়িয়ে বলে উঠি, ‘হ্যাঁ, বলছি, বৃষ্টি কমে গেছে। আমি আসছি।’ এই বলে আমি দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম।
ব্যাগটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি। এমন সময় একটা মৃদু পদশব্দ পেলাম। সুলগ্না দেখি আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি ওর দিকে ফিরলাম। বললাম, ‘উনি কে? তোমার স্বামী?’ সুলগ্না মাথা নাড়িয়ে বলে, ‘হ্যাঁ। একটা কলেজের প্রফেসর ছিলেন। গত বছর একটা গাড়ি অ্যাকসিডেন্টে…’ কিছুক্ষণ থেমে সে আবার বলে, ‘এখন পুরো অথর্ব। নিজে থেকে কিছুই করতে পারে না।’ তারপরে একটা নিস্তব্ধতা। আমি বললাম, ‘তুমি আর গল্প লেখো সুলগ্না?’ ও মাথা নাড়ায়। লেখে না। আমি বললাম, ‘ছাড়লে কেন লেখাটা?’ ও কোনো উত্তর করলো না। বেরিয়ে আসার আগে ওকে একবার বলে এলাম, ‘ভালো থেকো।’ তারপর ধীরে ধীরে পথ চলতে লাগলাম আমি। যেতে যেতে মনে হল, ওকে আমার বাড়ির ঠিকানাটা দিয়ে এলে হতো। তারপর ভাবলাম, থাক, কী হবে আর পিছনে ফিরে? ওসব আর না ভাবাই ভালো। আমি এগোতে লাগলাম, আর আমার পেছনে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে লাগলো একটা পুরনো অতীত।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Dipok Kumar Bhadra খুব সুন্দর লিখেছেন।
ভালো লাগেনি ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১
ফয়জুল মহী সুন্দর উপস্থাপন।

০৫ সেপ্টেম্বর - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ৮ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪